রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে কি করনীয় এবং কি খাওয়া জরুরি জানুন
হিমোগ্লোবিন বলতে বোঝায় মূলত আমাদের রক্তে অবস্থিত প্রোটিনকে। এটি রক্তের লোহিত কণিকায় থাকে। প্রিয় পাঠক আজকে আলোচনা করব রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে আপনারা কি করবেন এবং কি খেলে রক্তের হিমোগ্লোবিন বেড়ে যাবে সে সম্পর্কে।
শরীরে হিমোগ্লোবিনের অভাব দেখা দিলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা বেড়ে যায়। বিশেষ করে যখন আয়রনের অভাব হয় তখন হিমোগ্লোবিনের স্তর আস্তে আস্তে কমতে থাকে।
ভূমিকা
আমাদের দেশে সাধারণত রক্তস্বল্পতায় পুরুষের তুলনায় মহিলারা বেশি সমস্যায় ভুগেন। শরীরে পর্যাপ্ত রক্তের অভাব যখন হয় তখন হিমোগ্লোবিনের স্বল্পতা দেখা দেয়। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন রকম সমস্যা যেমন শারীরিক দুর্বলতা শ্বাসকষ্ট ক্লান্তি ভাব ইত্যাদি সমস্যা গুলো দেখা দেয়।
হিমোগ্লোবিন কম থাকার অর্থ কি
আমরা কমবেশি অনেকেই জানি রক্তের অন্যতম উপাদান হলো লোহিত রক্তকণিকা। লোহিত রক্ত কণিকার মধ্যে থাকে এক ধরনের প্রোটিন যা অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই প্রোটিনই হলো হিমোগ্লোবিন। যা একই সঙ্গে দেহের বিভিন্ন অঙ্গের কোষ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের করে নিয়ে আসে। এরপর ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছে বিষাক্ত গ্যাস গুলোকে দেহের বাইরে বের করে দেয়।
অর্থাৎ এক কথায় স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করতে হলে শরীরের জন্য পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন খুবই জরুরী। হিমোগ্লোবিনের আবার দুইটি অংশ রয়েছেঃ হিম এবং গ্লোবিন। হিম অংশে উপস্থিত থাকে হলো আয়রন। তাই হিমোগ্লোবিন গঠনে আয়রনের কোন বিকল্প নেই। এক কথায় হিমোগ্লোবিন কম থাকার অর্থ হলো, আমাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ ঠিকঠাক মতো না হওয়া।
শরীরে ঠিকঠাক মতো অক্সিজেন সরবরাহ না হওয়ার কারণে যখন শরীরে বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দেয় যেমন দুর্বল ভাব মাথা ব্যথা শ্বাসকষ্ট ক্লান্তি হার্টের দ্রুত স্পন্দন ত্বক ফ্যাকাস হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ। রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা হ্রাস পাওয়াকে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা বলা হয়।
রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে করণীয়
রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে কিছু খাবারের মাধ্যমে আপনি আবার আপনার শরীরের হিমোগ্লোবিন সঠিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারবেন। তাহলে চলুন জেনে নেই কি সেই খাবারগুলো যেগুলো খেলে আপনার শরীরের অনেক বড় সমস্যা সমাধান হয়ে যাবেঃ
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার
ভিটামিন সি এর অভাব হলে রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যেতে পারে। তাই প্রচুর পরিমাণে কমলা লেবু স্ট্রবেরি টমেটো পেয়ারা ইত্যাদি ফলমূল খেতে হবে। এছাড়াও এগুলো লৌহ শোষণের সহায়তা করে ফলে আমাদের রক্তে হিমোগ্লোবিন বেড়ে যায়।
রঙিন সবজি এবং ফলমূল
আপেল ব্রকলি লাল আঙ্গুর এগুলোতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন এবং ক্যালসিয়াম যা আমাদের শরীরে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে সাহায্য করে। তাই প্রতিদিন কমবেশি আমাদের টাটকা ফলমূল খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
সামুদ্রিক মাছ
সামুদ্রিক মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে লৌহ এবং খনিজ লবণ। যা আমাদের শরীরের রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া থেকে রক্ষা করবে। নিয়মিত চিংড়ি কাঁকড়া সহ বিভিন্ন রকম সামুদ্রিক মাছ খেতে পারেন। এতে আপনার রক্তে হিমোগ্লোবিন বেড়ে যাবে।
ডাল জাতীয় শস্য
ছোলা সয়াবিন এবং বিন জাতীয় খাবারে থাকে প্রচুর পরিমাণে আয়রন। এক্ষেত্রে যারা নিরামিষ খাবার খেতে পছন্দ করেন তাদের কাছে সয়াবিন একটি জনপ্রিয় খাবার। থেকে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয় যা আমাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
শস্যজাতীয় খাবার
রক্তশূন্যতায় যারা ভুগেন তারা প্রতিদিন চাল গম কিংবা ওটস জাতীয় খাবার খেতে পারেন। কারণ এসব খাবার প্রচুর আয়রন সমৃদ্ধ সেসঙ্গে থাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট। তাই নিয়মিত এসব খাবার খেলে কিছুদিনের মধ্যেই আপনার রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বেড়ে যাবে। তাছাড়াও নিয়মিত লাল চালের ভাত খেতে পারেন।
ডিম খান নিয়মিত
আমাদের শরীরের সুস্থতা ধরে রাখতে চাইলে নিয়মিত ডিম খেতে হবে। কারণ ডিমে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি এবং আয়রন শরীরের জন্য নানাভাবে উপকার করে। এছাড়াও ডিমের কুসুমে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এবং খনিজ পুষ্টি যা শরীরের দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করে।
বিটরুট
প্রাকৃতিকভাবে বিট রোডে প্রচুর পরিমাণ লৌহ রয়েছে। এছাড়াও আছে ম্যাগনেসিয়াম ফসফরাস ভিটামিন বি এবং ভিটামিন সি। এ ধরনের সবজিতে রয়েছে খনিজ সম্পদ এবং ভিটামিন। তাই সবজির মধ্যে বিটরুট আপনি খেতে পারেন।
সজিনা পাতা
জিংক লোহা তামা ম্যাগনেসিয়াম এর মত খনিজসহ ভিটামিন এবিসি দ্বারা পূর্ণ আমাদের আশেপাশে পাওয়া সজিনা পাতা। কি অবাক হচ্ছেন! অবাক হলেও এটাই সত্যি কথা। প্রতিদিন ভাতের সঙ্গে সজিনা পাতা শাক হিসেবে খেতে পারেন। এতে খুব কম সময়ে আপনার রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অনেক বেড়ে যাবে।
তিল
কালো তিলের রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম সহ ফোলেট। একবাড়িতে এক চা চামচ তেল নিয়ে সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে খালি পেটে খেয়ে নিলে রক্তস্বল্পতা সমস্যা মিটে যায়। এমনকি মধু দিয়ে তিলের নাড়ু খেতে পারলেও আপনার উপকার হবে।
আপেল
দিনে একটি করে আপেল খেলে রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ে তো ঠিকই তার পাশাপাশি আমাদের শরীরের আরও বিভিন্ন রকমের উপকারও করে। তাই প্রতিদিন খাবারের তালিকায় একটি করে আপেল রাখার চেষ্টা করুন।
বেদানা
বেদানা তে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ক্যালসিয়াম শর্করা এবং ফাইবার। বেদনা আমাদের শরীরে প্রচুর পরিমাণ হিমোগ্লোবিন বাড়ায়। তাই প্রতিদিন একটা করে বেঁধে না খাওয়ার চেষ্টা করুন।
মাংস খাবেন যে কারণে
আমাদের শরীরে হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর আরেকটি উৎস হতে পারে প্রাণিজ প্রোটিন। সব ধরনের লাল মাংসই প্রাণিজ প্রোটিনের অন্যতম একটি উৎস। তাই রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে নিয়মিত মোটা মাংস খেতে পারেন এবং তার পাশাপাশি গরু খাসির কলিজাও খেতে পারেন। কেননা এগুলো আয়রনের প্রধান এক একটি উৎস।
খেজুর কিসমিস ডুমুর
খেজুর ও কিসমিসে রয়েছে আয়রন এবং ভিটামিন সি এর উপযুক্ত উৎস। কোন দিকে ডুমুরে রয়েছে যথেষ্ট মাত্রায় আয়রন ম্যাগনেসিয়াম এবং ফলেট। প্রতিদিন সকালে তিনটি করে খেজুর এক মুঠো কিসমিস এবং শুকনা ডুমুর মিশিয়ে খেলে রক্তস্বল্পতা সমস্যা থেকে খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি পাওয়া যায় এবং শরীরে প্রচুর পরিমাণ এনার্জিও থাকে।
কালোজাম
ভিটামিন সি এবং আয়রনের ভরপুর কালো জাম। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে শরীরের রক্ত সঞ্চালনা ভালো হয়। আর রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে কালোজাম খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই কালোজাম খাদ্য তালিকা থেকে একদমই বাদ দেওয়া যাবে না।
পেস্তা
রোজ সকালে তিন থেকে চারটা পেস্তা খেতে পারলে খুবই উপকার হয়। পেস্তা খেলে আমাদের স্মৃতিশক্তি বাড়ে। এর মধ্যে রয়েছে ৩০ রকমের ভিটামিন এবং আয়রন।
ডার্ক চকলেট
হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি কমাতে ডার্ক চকলেট দারুন কার্যকর। এছাড়াও মিল্ক চকলেট আমাদের শরীরে প্রচুর পরিমাণে রক্তে শর্করা মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই চকলেট খেলে আপনার শরীরে আয়নের ঘাটতি অনেকটাই কমবে।
আরো কিছু টিপস জানুন
আয়রন রোধি খাদ্য নয়
শুধু আয়রনসমৃদ্ধ খাদ্য খেলে চলবে না, তার সঙ্গে এমন কিছু খাদ্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে যেগুলো শরীরে আয়ন প্রবেশ করা আটকায়। অর্থাৎ পলিফেনলস, টেনিন, এবং অক্সালিক এসিডযুক্ত খাদ্য গ্রহণ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
ফলিক এসিড
ভিটামিন বি এর বিশেষ ভাগ হলো ফলিক এসিড। বহু মানুষের শরীরে এই ভিটামিনের ঘাটতি থাকে এবং তার ফলে দেখা দেয় বিভিন্ন রকম সমস্যা। সে ক্ষেত্রে রক্তে হিমোগ্লোবিনের বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দেয়। তাই প্রত্যেকটি মানুষকে এইসব বিষয় খেয়াল রেখে সাবধানে চলতে হবে। এক্ষেত্রে পাউরুটি মটর এবং বিভিন্ন বাদাম জাতীয় খাবারে ভালো পরিমান ফলিক এসিড থাকে তাই এগুলো খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
কপার যুক্ত খাবার
কপার আমাদের শরীরের জন্য অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি খনিজ। এই খনিজ খেলে হিমোগ্লোবিন সরাসরি তৈরি হয় না তবে রক্তকণিকাতে আয়রন পৌঁছে দিতে সাহায্য করে।
ভিটামিন বি ১২
আপনি যদি সব সময় ক্লান্তি অনুভব করেন তাহলে ভিটামিন বি টুয়েলভ খাওয়ার কোন বিকল্প নেই। ভিটামিন আমাদের শরীরে পুষ্টি যোগায়। শুধু তাই নয় এর সাথে রক্তের হিমোগ্লোবিনও বাড়ায়। তাই আমাদের শরীরের অ্যানিমিয়া দূর করার জন্য অবশ্যই ভিটামিন বি 12 খেতে হবে।
ভিটামিন এ
ভিটামিন এ প্রচুর পরিমাণে শরীরে হিমোগ্লোবিন বাড়িয়ে দিন। সবুজ রঙের সবজি সহ গাজর শুকনো মরিচ দুধ ও দুগ্ধ জাত খাবার ইত্যাদি খাবারের প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ থাকে। এর মধ্যে ভিটামিন শাক এর একটি উৎস হলো পালং শাক।
শেষ কথা
প্রিয় পাঠক উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানলাম আমাদের শরীরে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে আমরা কিভাবে ঘরোয়া উপায়ে কয়েকটি খাবার খেয়ে শরীরের রক্তের হিমোগ্লোবিন সঠিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারি। আশা করি আজকের পোস্টটি আপনাদের খুব ভালো লেগেছে এবং আপনারা খুবই উপকৃত হয়েছেন।
আজকের পোস্টটি পড়ে যদি আপনি উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন। আরো কিছু জানার থাকলে অবশ্যই আমাকে কমেন্ট করে জানাবেন। সে পর্যন্ত সকলে সুস্থ থাকবেন এবং ভালো থাকবেন। আজকে এই পর্যন্তই। এতক্ষন আবার পোস্টের সাথে থাকার জন্য সকলকে ধন্যবাদ। দেখা হবে পরের কোন পোস্টে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url